Friday, February 9, 2018

মায়াময় ভোর : ইসহাক হাফিজ



অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সূর্যোদয়ের তখনো আধা ঘণ্টার মতো বাকি। ভোরের উপাসনা এইমাত্র শেষ করে জারা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আঙিনায় ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকা একাশিয়া গাছ। ঝাপসা অন্ধকারের ভেতর হিম সাদা অদেখা খেয়ালের মতো কী যেন হঠাৎ মিলিয়ে যায়। জারার শরীরটা কাঁটা দিয়ে ওঠে। অস্পষ্ট হলুদ ফুলগুলো কেমন মোহময়। শীতের সকালে কুয়াশাভেজা বিস্তীর্ণ সর্ষের হলুদ আর হলুদ। বহুদিন বৃষ্টিহীন-অযত্নে মরা প্রেমের মতো ধুলোমলিন ঘাস। এখানে-ওখানে ধুলার ভেতর মিশে যায় পাখিদের পালক। অনেক কথার ভিড়ে শুধু বেখেয়ালে হারিয়ে যাওয়া কিছু কথার মতো। আজ তার মন সুন্দরের গতিপ্রকৃতি হয়তো চিনেছে, তবে সময়ের স্রোতে সময় তো বয়েই গেছে।

ক্যাম্পবেল টাউনের ম্যাকিউরি অ্যাভিনিউ। এখানে প্রায় চার বছর আগে শুরু হয়েছিল এক বছরের ছেলে মিলানকে নিয়ে জারা আর জ্যাকবের সংসার। আজ জারার খুব মনে পড়ছে বিয়ের পরপরই আনন্দময় দিনগুলোর কথা। হানিমুনে নেপাল-দার্জিলিং ভ্রমণ। জ্যাকব তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখা ওই কোমল সাদা মেঘ। রিসোর্টের জানালার কাছে সূর্যোদয়েরকালে দুজনে পাশাপাশি বসে মেঘ আর পাহাড়ের জড়াজড়ি দেখা। জ্যাকবের বুকে নিবিড়ভাবে শুয়ে শান্তির পরশ। শজনে ফুলের মতো শীতল শান্তি। নীলগিরি পাহাড়ের ওপর মেঘ মুগ্ধ মন। অচেনার মাঝে খুঁজে পাওয়া ওই প্রিয় গান। নিঃশব্দের ভেতর থেকেই যেন শব্দ ধেয়ে আসে। সেন্ট মার্টিনের ওই কেয়াগাছ ছুঁয়ে আসা বাতাস। সাগর-ঢেউ-প্রবাল। ভেজা বালির বুকে ঢেউয়ের রেখে যাওয়া স্মৃতি। নির্জন জোছনায় তুমি আর আমি। ঢেউয়ের ছলছল। গান নয়, তবু যেন গান। ভাষাহীন কবিতার মতো। ওই সব দৃশ্য যেন আজ প্রাণ ফিরে পায় স্মৃতির ভেতর। আরও কত স্মৃতি! শান্তির স্রোতে ভেসে কখনো শান্তিকে চিনতেই পারে না অদ্ভুত খেয়ালি মন। পৃথিবীর সুখের দিনগুলো বুঝি মনের ওপর কঠিন দাগ কেটে সরেই যায় কেবল। ফিরে আসে না আর। এমনই কিছু অস্পষ্ট ইঙ্গিতের নীরব উপহাসে ভারী হয়ে আসে এই নির্জন ভোর।
হাসপাতাল থেকে শিশু মিলানকে নিয়ে সিডনির সিবিডির কাছে জারা যখন ওই ভাড়া বাসাটিতে আসে, তখন খেয়াল করে দেখে জ্যাকবের মনটা যেন অখুশি। জানতে চাইলে সে বলেছিল, জারা, ছেলেকে নিয়ে বাসায় এসেছি। আনন্দ তো অবশ্যই। সেটা কী আর বলার অপেক্ষা রাখে?
জ্যাকবকে চুপ করে থাকতে দেখে জারা বলল, কিছু বলতে চাও মনে হচ্ছে।
—বলে আর কী হবে। ছেলেকে নিয়ে যে এই ভাড়া বাসায় উঠতে হলো, কেমন যেন ব্যর্থতাবোধ কাজ করছে। আমি মনে হয় সফল বাবা হতে পারিনি।
চরম বিরক্তিতে জারা বলেছিল, কী যে বলো এসব। সময় তো আর এমন থাকবে না। নিজের একটা বাসা হবে। এটা এ দেশে তেমন জটিল কিছু না। এখন ওসব চিন্তা বাদ দাও।
—বাদ দিতে পারছি না যে। কেমন যেন লজ্জা করছে। আমাদের ভাইবোনগুলোর কারও জন্মই তো ভাড়া বাড়িতে হয়নি। এ যেন আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না।
—এই, তুমি চুপ করো তো। বিদেশ বলে কথা। এই গ্রেটার সিডনিতে বাড়ি কেনা! এ কী কেবল মুখে বললেই হয়? সেভিংসও তেমন নেই। রাখো, ছয়-সাত মাস ধৈর্য ধরো। আমি চাকরিতে ব্যাক করলেই কোনো একটা ইনিশিয়েটিভ নেওয়া যাবে। তখন লোন নিতে আর সমস্যা হবে না।
হলোও তাই।
প্রথম দিকে অতি ব্যস্ততা। তবু একটি বাসা কেনা হলো। সেটেলমেন্ট শেষে বাসা মুভ করা, কী করে যেন সব যথাসময়েই হয়ে গেল। ছেলেকে নিয়ে সার্বক্ষণিক ব্যস্ততায় জারার বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠত না। তাই লোন অফিসার, সলিসিটার আর রিয়েল স্টেট এজেন্টের লোকদের বাসায় নিয়ে এসে কাগজপত্র সই করিয়ে নিয়ে সব রকমের ইন্স্যুরেন্সগুলোও আপডেট রাখত জ্যাকব।
শিল্প-সাহিত্যের প্রতি প্রবল ঝোঁক জ্যাকবের। সে প্রায়ই বলত, জীবনটাকে শিল্পময় করতে না পারলে জীবন সুখের হয় না। শিল্পের ভেতর দিয়েই কেবল সত্য-সুন্দরকে ধরা যায়।
নতুন বাসাটা সাজানো হয়েছে। প্রতি উইকেন্ডে সন্ধ্যাবেলায় বাসায় গানের আসর বসে। সে নিজে পিয়ানো বাজিয়ে, কখনো ভায়োলিন বাজিয়ে গান করত। সঙ্গে আরও তিনজন সংগত করত। গানের আগে দীর্ঘ সময় কেটে যেত মিউজিকে। পরিচিত-অপরিচিত কত রকমের গানের মেলোডি যে উঠে আসত ওই মিউজিকে। কখনো লোকজ গানের সুরে সুরে বাড়িটাকে শিল্পময় একখণ্ড বাংলা মনে হতো।
ছোট্ট এই মিলান তার বাবার কোলে বসে চুপ করে কেবল মিউজিক শুনত। তখন এই শিশু যেন অন্য কেউ। দুষ্টুমি বা কোনো জ্বালাতন কিছুই নেই। স্নিগ্ধ নীরব এক শিশু। এভাবে মিলানের বয়স যখন দুই বছর, তখন এই ক্যাম্পবেল টাউন এলাকায় ধর্মের অনুশীলন খুব জোরালো হতে থাকে। কী কারণে যেন সবার অন্তরে ঢুকে যায় পরকালের ভয়। ইহজগৎ কিছুই নয়, পরকালের জীবন হলো আসল জীবন। এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই গ্রিক এক নারী ধর্মের উপদেশ দিয়ে এলাকার সব মেয়েকে মোটিভেট করে ফেলেন। ওই নারীর ধর্মোপদেশ চলাকালে বিয়ের আগে জ্যাকবের সঙ্গে যৌবন-উন্মাদনার একান্ত মুগ্ধ কিছু ভালোবাসার দিনের কথা স্মরণ করে অনুশোচনায় কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয় জারা। তাঁর উপদেশ অনুসারে একদিন অমঙ্গলের প্রতীক সব বাদ্যযন্ত্র জারা কোনোটা পুরোপুরি ভেঙে, কোনোটা আধভাঙা করে ম্যাকিউরি অ্যাভিনিউর ক্লিনআপ ডেতে সুযোগমতো বাইরে ফেলে দেয়।
সন্ধ্যায় জ্যাকব বাসায় এসে বাদ্যযন্ত্রগুলো দেখতে না পেয়ে একেবারে বাক্যহারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জারা বলল, গান-বাজনা পাপের উৎস। ওগুলোকে ফেলে দিয়েছি। আজ থেকে বাসায় এসব বন্ধ।
হতভম্ব জ্যাকব আহত পাখির মতো কাঁপতে লাগল। তারপর বলল, তুমি কী বলছ এসব! আমি যে বিশ্বাসই করতে পারছি না।
জারার মন তখন বড় স্থির। একটা সময় ছিল, যখন জ্যাকবের মন একটু খারাপ হলেই জারা টের পেত। প্রকৃত কারণ বের করে বিষয়টার সমাধান না করা পর্যন্ত সে অস্থির হয়ে পড়ত। সময় তাকে কেমন পরিবর্তন করেছিল তখন, ভাবতে আজও শরীরটা শিউরে ওঠে। খুব কঠিন অথচ বেশ শান্তভাবে বলল, হ্যাঁ, বিয়ের আগে তোমার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে এমন সব কাজ করেছি, যা ধর্ম সমর্থন করে না। মনে পড়ে, সেবার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমাকে নিয়ে ওই নীলগিরি দেখতে গিয়েছিলে। অথচ তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় মাস্টার্স শেষ করার পর। রিপুর তাড়নায় পবিত্র ঈশ্বরকে নাখোশ করে আজ আমার অনুশোচনার শেষ নেই। তাই তোমাকেও বলি, যদি ঈশ্বরকে খুশি রাখতে চাও, তাহলে ধর্মের পথে চলে এসো। এসব অধর্ম ত্যাগ করো।
গালে হাত দিয়ে ড্রয়িংয়ে বসা জ্যাকব একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের ভালোবাসাকে অস্বীকার করছ, তাই না?
—ওসব আমি বুঝি না। এখন থেকে ধর্মের সমস্ত বিধিনিষেধ তোমাকে মানতে হবে।
—ধর্ম-অধর্মের ব্যবধানটা আমি জানি। ধর্মের দোহাই দিয়ে তুমি মনে হয় আমার ওপর অত্যাচার করে ফেলেছ। এসব লোকজ গানের যন্ত্রগুলো আমার খুব শখের। কত কষ্ট করে এগুলো দেশ থেকে এনেছি তা তুমি জানো? আমার লাখ ডলারের ক্ষতি হয়ে গেলেও এত শকড হতাম না। জারা তুমি এ কী করলে! তোমাকে এত ভালোবাসি, এত বিশ্বাস করি...।
কথাগুলো বলেই জ্যাকবের স্বর বিকৃত হতে শুরু করে। কথাবার্তা আর হলো না তেমন। সেদিন থেকেই জ্যাকব আলাদা রুমে থাকতে শুরু করে। এ নিয়ে জারারও কোনো আপত্তি ছিল না। কারণ, ওই গ্রিক নারী প্রার্থনার প্রস্তুতি বিষয়ে যা বলেছিলেন, তাতে স্বামী-স্ত্রীকে মিলনের পর অবশ্যই নিয়মমাফিক শাওয়ার করে প্রার্থনা শুরু করতে হবে। শীতপ্রধান এ দেশে বছরের বেশির ভাগ সময় তাপমাত্রা যেখানে পাঁচ-ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস, শেষ রাতে কখনো জিরো ডিগ্রিতে নেমে আসে, কী করে সম্ভব এত ভোরে শাওয়ার করা। তাই প্রথম দিকে জ্যাকব পাশে এসে শোয়ামাত্রই জারা এমন সব আচরণ শুরু করত, যাতে করে ওই রকম পরিবেশটাই যেত নষ্ট হয়ে। এভাবে ক্লান্ত জ্যাকব কথা না বাড়িয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ত। জারাকেও শেষ রাতের প্রার্থনায় আর কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। জ্যাকব আলাদা ঘরে শোয়ায় জারা খুশি হয়ে তার প্রার্থনার পথ থেকে যন্ত্রণা সরে গেছে বলে ঈশ্বরকে দেয় অসংখ্য ধন্যবাদ। এভাবেই জারা উপাসনা নিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একসময় স্বামী-স্ত্রীতে কথাবার্তাও কমে আসে। বাসায় ফিরে জ্যাকব কিছুক্ষণ মিলানের সঙ্গে মাখামাখিতে মেতে থাকত। তারপর কী সব বই পড়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ত।
এমন করে প্রায় ছয় মাস কেটে গেলে জারার মনে কতগুলো ঝাপসা জিজ্ঞাসা উঁকি দেয়। গ্রিক ওই গুরু নারীর সঙ্গে বিষয়টা আলোচনা করতেই তিনি বেশ কিছু সম্ভাব্য দুর্ঘটনার আভাস দিয়ে জারাকে সতর্ক করে দিলেন। আরও বলে দিলেন, স্বামীকে চোখে চোখে রাখতে। কারণ, পুরুষদের বিশ্বাস নেই।
চোখে চোখে রাখা কী আর সম্ভব? পুরুষ মানুষকে বাড়ির বাইরে তো যেতেই হয়। এভাবেই নিজের মতের ভেতর মতামত তৈরি করে সন্ধ্যায় জ্যাকব বাসায় ঢোকামাত্র শুরু হলো জারার প্রশ্নের পর প্রশ্ন, এই, তুমি যে আমার সঙ্গে থাকো না, শখ মেটাও কার সঙ্গে?
জারার অত্যাচারে সর্বক্ষণ এক অজানা আতঙ্কের মধ্যে থাকত জ্যাকব। অদ্ভুত এই প্রশ্নে হঠাৎ চোখ দুটো তার ঝাপসা হয়ে আসে। যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, কী সব আবোলতাবোল বকছ তুমি!
আগে আমার কথার জবাব দাও। বিয়ের আগেই যে ছেলে শুধু ভালোবাসার অজুহাতে নারীতে মজা লোটে তাকে আর বিশ্বাস কী?
একটা নীরব নিশ্বাস ছেড়ে জ্যাকব বলল, ভালোবাসার অজুহাত! নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা তুমি বেশ ভালোই শুরু করেছ। যাক, ওসব বলে আর কী হবে। এই বিদেশের বাড়িতে মাইগ্রেটেড লোকজন আমরা। না আছে কোনো আপনজন, না আছে কোনো আত্মীয়স্বজন। এখানে তুমিই যদি এমন অবুঝের মতো আচরণ করো, তাহলে চলবে কী করে।
জারা আরও কিছু প্রশ্ন করে। জ্যাকব কোনো কথারই জবাব দেয় না। নিজের কক্ষে ঢুকে দরজা ভেতর থেকে লক করে দেয়। জারা রেগেমেগে আগুন হয়ে দরজায় সজোরে লাথি মেরে বলল, তুমি ধর্মকর্ম কিছুই করো না। তোমাকে বিশ্বাস কী?
ভেতর থেকে জ্যাকব বলল, তোমাকে বিশ্বাস করতে কে বলল। কীসের ভিত্তিতে কী সব ইস্যু তৈরি হচ্ছে, আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার উল্টাপাল্টা আচরণের ভয়ে আমি দূরে সরে গেছি। তাও গায়ে পড়ে এসে ঝগড়া করো। এসবের কী কোনো মানে হয়?
জারা চেঁচিয়ে বলতে লাগল, তোমাকে ধর্মের পথে আনা আমার দায়িত্ব। আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। এ দায়িত্বের সঙ্গে যে আমার পরকালের শুভ-অশুভ জড়িত।
—ধর্মবিশ্বাস খুবই সেনসিটিভ বিষয়। এ নিয়ে তোমার সঙ্গে তর্ক করার সাধ্য আমার নেই। ওই জ্ঞানও তোমার নেই। তবে এটুকু মনে রেখো, এই ধর্মের ভেতরই বহু মানবতাবাদী মহাপুরুষ আছেন, মানুষ যাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। আবার এই ধর্মের মুখোশ পরেই একটি দল বড় বড় অপকর্ম করে যাচ্ছেন। আসলে তোমার ভেতর তোমার রূপটাই প্রকট হচ্ছে-অন্য কিছু না।
—আমাকে অভিযুক্ত না করে তুমি নিজে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাও। তাঁর পছন্দের পথে চলে এসো। আমার জীবনে বড় বড় পাপের কারণ কেবল তুমি।
—পাপ! আমি তোমার জীবনে বড় বড় পাপের কারণ? বুঝতে পারলাম না। আচ্ছা, এবার দরজার সামনে থেকে সরে যাও প্লিজ। শরীরটা আজ আমার ভালো না। একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
এভাবে আরও মাস তিনেক কেটে যায়। এ পর্যায়ে তিন-চার দিন চলে যায় স্বামী-স্ত্রীতে একটা শব্দ বিনিময়ও হয় না। জ্যাকব বাসায় এসে নিজেই রান্না করে। ডিমের তরকারি, আলুভর্তা, ডালের চচ্চড়ি—এই সব। জারা সারা দিন ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত। আর সপ্তাহে দুদিন ওই গ্রিক নারীর কাছে কয়েক ঘণ্টা ধর্মের বাণী শুনতে যায়। ছেলেকে নিয়ে রান্না করা বেশ কঠিন, এই ভেবে ওই নারী প্রতি সপ্তায় কিছু তরকারি দেয়। জারা ওই তরকারি দিয়েই দিন পার করে। অথচ জ্যাকব এসব খাওয়া তো দূরের কথা, ছুঁয়েও দেখে না। এভাবেই ইহলৌকিক দায়দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে পারলৌকিক চিন্তায় বিভোর হয়ে জারার দিন কাটতে থাকে।
আজ একটা ঘটনার কথা মনে পড়ায় কী এক অজানা কষ্টে জারার বুকটা যেন ভেঙে যাচ্ছে। অশ্রুভেজা চোখে কী এক ইঙ্গিতের সুর ধরে ওই সুরের ঝরনাধারায় পৃথিবীতে নেমে আসে মায়া। সেদিন সন্ধ্যায় জ্যাকব যখন বাসায় ফেরে, ডান হাতে বুকটা চেপে ধরে নুয়ে নুয়ে হাঁটছিল সে। বুকটা ব্যথা করছিল মনে হয়। ওই রাতে ভোর চারটায় সে নিজেই অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেয়। অ্যাম্বুলেন্সের লোকজন এসে যখন বাসার কলবেল টিপল, তখন কঠিন বিরক্তিতে জারা দরজা খুলে দিলে ততক্ষণে তার বিরক্তির সব কারণই অকারণের স্তরে নেমে আসে। জ্যাকবের নিথর দেহখানা নিয়ে গেল ওরা। নির্বাক জারা কেবল চেয়েই রইল।

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

যে ১০ ভুলে সব মাটি

চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে যাবেন। বড় উপলক্ষ—হ্যাঁ, উপলক্ষই তো! একটি সাক্ষাৎকারেই তো ঘুরে যেতে পারে আপনার জীবনের মোড়। সমৃদ্ধির পথে শুরু হতে পারে আপনার পথচলা। এত বড় যে উপলক্ষ, সেখানে তো অবশ্যই ভালো প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া উচিত। নিজেকে একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করা, একটু উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া, কথাবার্তায় সতর্ক থাকা—এগুলো তো অবশ্যকরণীয়। অনেক আরাধ্য যে সাক্ষাৎকার, সেখানে যেকোনো অসতর্কতা কিন্তু সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে চাকরিপ্রার্থীর জন্য। কিছু জিনিস আছে, যা চাকরির সাক্ষাৎকারে কখনোই করা উচিত নয়। কী সেগুলো, একবার চোখ বুলিয়ে প্রস্তুত হন সামনের কোনো সাক্ষাৎকারের জন্য...

১. অনাগ্রহ

আপনার আবেদন দেখেই কিন্তু প্রতিষ্ঠান আপনাকে সাক্ষাৎকার দিতে ডেকেছে। আপনাকে নেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু সেখানে সাক্ষাৎকার যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁদের সামনে যদি আপনার অনাগ্রহ প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তাহলেই কিন্তু সর্বনাশ! এটা ঠিক, চাকরিপ্রার্থীরও চাকরি নিয়ে পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। এমন হতে পারে, আপনি হয়তো পছন্দের চাকরির সাক্ষাৎকারের আগেই একটু কম পছন্দের চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে এসেছেন, কিন্তু তারপরও অনাগ্রহ দেখাবেন না।

২. অপরিপাটি বেশভূষা

আগেই বলা হয়েছে, চাকরির সাক্ষাৎকার মানুষের জীবনের বড় উপলক্ষ। সে কারণে এতে নিজের সবচেয়ে সেরা পোশাকটাই পরে যাওয়া উচিত। কথায় আছে, আগে দর্শনদারি তারপর গুণবিচারী। সাক্ষাৎকার কক্ষে আপনাকে দেখে যদি পছন্দই না হয়, তাহলে কর্তৃপক্ষ কেন আপনার ভেতরের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের খোঁজ নিতে চাইবে? চাকরির সাক্ষাৎকারে বেশভূষা তাই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

৩. দেরি করে যাওয়া

চাকরির সাক্ষাৎকারে দেরিতে আসা ভয়াবহ ভুল। এখানে কোনো অজুহাতের সুযোগ নেই। কারণ কর্মীর সময়ানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেরি করে সাক্ষাৎকার দিতে যাওয়াটাই একটা বড় ত্রুটি, সেখানে অজুহাত দেখানো আরও বড় ভুল। দেরি করে গেলে আপনার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যেতে বাধ্য।

৪. প্রস্তুতি ছাড়াই সাক্ষাৎকারে যাওয়া

আপনাকে দু-একটি প্রশ্ন করেই প্রশ্নকর্তারা বুঝে যাবেন আপনার প্রস্তুতি কেমন। তখন তাঁরা আপনার প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলবেন। সে কারণে প্রস্তুতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই বলতে পারেন, প্রশ্ন তো যেকোনো বিষয় নিয়েই হতে পারে—প্রস্তুতিটা কী নেব! অন্তত নিজের বিষয়টি সম্পর্কে বা যে পদে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, সেটি সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করে যাওয়াই যায়।

৫. অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা

‘আপনি আমাদের সম্পর্কে কতটুকু জানেন’ অথবা ‘আপনি এখানে কেন চাকরি করতে চান’—সাক্ষাৎকার পর্বে এই দুটি প্রশ্নের মুখোমুখি চাকরিপ্রার্থী হতেই পারেন। এসব প্রশ্নের জবাবে কখনোই অপ্রাসঙ্গিক কোনো কথা কিংবা অহেতুক প্রশংসা করবেন না। এ ধরনের কোনো কিছু বললে সেটা উল্টো আপনার যোগ্যতা কমিয়ে দেবে। যথাসম্ভব বুদ্ধিমত্তা এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কথা বলার চেষ্টা করুন।

৬. ফোনের রিং বেজে ওঠা

সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগে নিজের মোবাইল ফোনটি বন্ধ রাখা উচিত। সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় পকেটে ফোন বেজে ওঠাটা অশোভন ব্যাপার। এতে আপনার চরিত্রের নিস্পৃহ ভাবই ফুটে ওঠে। বোঝা যায়, কাজের প্রতি আপনার আগ্রহ কম। সাক্ষাৎকার যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁরা অনুমান করে নেন, চাকরি দিলেও আপনি ঠিক একই কাজ করবেন।

৭. আগের চাকরির বদনাম

নতুন চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে এসে আগের প্রতিষ্ঠান নিয়ে বাজে কথা বলা খুব অন্যায়। এটা একধরনের চারিত্রিক দোষ। আগের চাকরিটা নিয়ে আপনার মনে যদি কোনো ক্ষোভ থেকেও থাকে, নতুন চাকরির সাক্ষাৎকারের সময় তা চেপে রাখাই ভালো। সাক্ষাৎকার যাঁরা নেন, তাঁরা এই একটি ব্যাপার থেকেই আপনার সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাবেন। সে ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে অনেকটাই।

৮. বেতন জিজ্ঞাসা করা

সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েই বেতনের প্রসঙ্গ তুলে বসবেন না যেন। এটি বেশ অশোভন। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা যদি বেতনের প্রসঙ্গ তোলেন, তাহলে আগ বাড়িয়ে নিজের চাহিদার কথা বলতে যাবেন না। প্রতিষ্ঠানের বেতনকাঠামো সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করেই সাক্ষাৎকার দিতে যাওয়া ভালো। তবে নিজের চাহিদা সাক্ষাৎকারের সময় না জানানোই ভালো। ছেড়ে আসা প্রতিষ্ঠানের বেতন নিয়ে ভুল তথ্য দেওয়াও খুব বড় অপরাধ। সব সময় মনে রাখবেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাছেই অন্য প্রতিষ্ঠানের বেতনকাঠামোর প্রয়োজনীয় তথ্যাদি থাকে।

৯. প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে না জানা

যে প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিতে এসেছেন, সে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাক্ষাৎকার দিতে এসে যদি সেই প্রতিষ্ঠানের মৌলিক বিষয়গুলোই বলতে না পারেন, তাহলে সেটা বিপর্যয়কর। চাকরিদাতা আপনাকে চাকরি দেওয়ার উৎসাহই হারিয়ে ফেলবেন। তাই সাক্ষাৎকার দিতে যাওয়ার আগে সেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটু ধারণা নিয়ে যাওয়া উচিত।

১০. নেতিবাচক শরীরী ভাষা

‘চাকরি হলে আপনাকে প্রতিদিন অফিসের সময়ের বাইরেও থাকতে হতে পারে’—এমন কথা যদি আপনার পছন্দ না-ও হয়, তারপরও শরীরী ভাষায় নেতিবাচকতা ফুটিয়ে তুলবেন না। হাসিমুখে বলবেন, ‘সেটা আমি জানি’ বা ‘আমার কোনো অসুবিধা নেই’। ছুটির পরেও অফিসে থাকতে হতে পারে বলা মানে এই নয় যে আপনাকে প্রতিদিন থাকতে হবে। কিন্তু সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ই যদি আপনি মুখ কালো করে ফেলেন, তাহলে সেটি আপনার চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব রাখতে বাধ্য।

সূত্রঃ প্রথম আলো